জাকির হোসেন
সাভারের রানাপ্লাজা ধসের ঘটনা স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক কয়েকটি দলের শীর্ষনেতাও এটা ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে অবিহিত করে ভবনের মালিক যুবলীগ নেতা সোহেল রানার বিচারের দাবি জানিয়েছেন। অন্যদিকে, জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এই রানা যুব লীগের কেউ নন। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর গত বুধবার সকালে ভবন ধসের পর বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কিছু হরতাল সমর্থক ভবনটির ফাটল ধরা দেয়ালের বিভিন্ন স্তম্ভ ও ফটক ধরে নাড়াচাড়া করেছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। ভবনটি ধসে পড়ার পেছনে এটি একটি কারণ হতে পারে। পরদিন সচিবালয়েও সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেন তিনি। আর এ মন্তব্য নিয়ে নিজের দলের মধ্য থেকে শুরু করে সারাদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাস্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে গণমাধ্যমে শুরু হয় নানামুখী আলোচনা। এর মাধ্যমে এই ঘটনায় মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে তা দ্রুত ভিন্নখাতে পরিচালিত করা সম্ভয় হয়েছে। সাধারন মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্যে নিয়ে নানারকম রশিকতায় মেতে উঠেছে। ফেসবুকে ব্যাস্ত থেকেছে হাস্যরসাত্মক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে। মানুষের জীবন ও মৃত্যু নিয়ে ক্ষমতাসীনদের এমন নির্মম রসিকতা আমরা প্রায়শই লক্ষ্য করি। নিকট অতীতে ২০১০ সালের ৪ জুন নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে ১২১ জন মানুষ জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। ঘটনার দিন প্রতিটি গণমাধ্যম এ ঘটনার নানা দিক গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ ও সম্প্রচার করে। কিন্তু একদিন পড়েই পাল্টে যা দৃশ্যপট। গণমাধ্যম ব্যস্ত হয়ে পড়ে ‘তিন কন্যার বিয়ে’ নিয়ে। অগ্নিকাণ্ডের দিনে ওই এলাকায় দুই পরিবাবের তিন মেয়ের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। প্রধানমন্ত্রী তাদের বিয়ে দেবেন বলে ঘোষণা দেন। তারপর তিনি এই তিন কন্যাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর বিভিন্ন সংবাদপত্র ও বেসরকারী টেলিভিশন চ্যালেন এই তিন কন্যার বিয়ে নিয়ে নানা রকম প্রতিবেদন গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করতে শুরু করে। তিন কন্যাকে কোন পার্লারে সাজানো হচ্ছে, কোন দোকান থেকে শাড়ি কেনা হয়েছে, গণভবনে বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও আর কারা অতিথি থাকছেন – এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে শাসকদল ও বিভিন্ন গণমাধ্যম সুকৌশলে সামনে নিয়ে আসে। আর এই তিন কন্যার বিয়ের আলোক সজ্জার আড়ালে একদিনের ব্যাবধানে আড়াল হতে শুরু করে মানুষের ক্ষোভ এবং নিমতলী ট্রাজেডির নানা দিক।
সাভার ট্রাজেডির ক্ষেত্রেও শাসকশ্রেণীর শুরু থেকে মানুষের ক্ষোভ প্রতিহত করতে এবং জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে পরিচালিত করতে শাসকশ্রেণী অনুরুপ আচরণ লক্ষ্যনীয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৫ এপ্রিল জাতীয় সংসদে দাড়িয়ে সাভার ট্রাজেডি সম্পর্কে বলেন, ধ্বসে যাওয়া ভবন রানা প্লাজার মালিক যুবলীগের কেউ নয়। আমি টেলিভিশনে, নিউজে–ভিউজে দেখেছি অনেকেই বলেছেন এই রানা প্লাজার মালিক যুবলীগের। আমি সাভার যুবলীগের কমিটি নিয়ে এসেছি, সেখানে তার কোন নাম নেই। সরকারে এলেও তো সবাই সব দলের হয়ে যায়। আর এই ভবন তো হয়েছে ২০০৬ বা ০৭ সালে। যদিও ধ্বসে যাওয়া ৯ তলা ভবনের মালিক সোহেল রানা সাভার পৌর যুবলীগের আহবায়ক উল্লেখ করে প্রায় সকল পত্র–পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খবর প্রকাশত হয়েছে। কোন কোন গণমাধ্যমে তার ছবি সংবলিত পোস্টারও প্রকাশ করে। ছবিতে দেখা যায়, স্থানীয় সংসদ সদস্য তৌহিদ মুরাদ জং কপালে চুমু দিচ্ছেন ধসে পড়া ভবন মালিক রানাকে। এছাড়াও মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার ছবি এবং পোস্টারও প্রকাশিত হয় বিভিন্ন দৈনিকে। ওই ভবনের গার্মেন্ট মালিকদের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগের দিন যেখানে ফাটল ধরা পরার মত সবাইকে ভবন থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন গিয়ে ভবনটি ব্যবহার অনুপযোগী উল্লেখ করে। সেখানে পুলিশী পাহারাও বসানো হয়। এর পরদিন ভবনটি ঝুকিপূর্ণ জানা সত্ত্বেও এর মালিক (গামেন্টের) শ্রমিকদের কাজ করার জন্য, সেখানে জোর করে ঢুকিয়েছে। ভবনটি কে ঢুকিয়েছে কারা ঢুকিয়েছে তার তথ্য আমরা বের করছি।
প্রধানমন্ত্রী অবস্থান যদি এমন হয় তবে তার মন্ত্রীরা তার পথ অনুসরণ করবেন এটা আমাদেশের দেশে খুব স্বাভাবিক এবং বতর্মান সময়ে তেমনটিই ঘটছে।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর–রুনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে গত বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দুই সাংবাদিককে নিজের ঘরে মারা হয়েছে। সরকারের পক্ষে কারও বেডরুম পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। আর এ সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কক্সবাজারের রামুসহ কয়েকটি স্থানে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলার প্রসঙ্গে গত ০২ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, হামলার ঘটনা ছিল পরিকল্পিত। তাই এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা ছিল বলে মনে হয় না। তাছাড়া প্রতিটি ঘরে ঘরে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ, যেমন প্রধানমন্ত্রী তেমনই তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
বর্তমান সরকারের শেষ বেলায় গত বছর ১৩ সেপ্টে¤¦র স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহন করেন এই মহিউদ্দিন খান আলমগীর। গত ৭ মাসে বিভ্রান্তিকর কথামালার সঙ্গে নানারকম বির্তক তৈরি করা ছাড়া তার কোনো সাফল্য খুজে পাওয়া যাবে না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কতিপয় আলোচিত বক্তব্য নিম্নে তুলে ধরা হলো–
গত ২৪ সেপ্টে¤¦র নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী সম্পর্কে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, তিনি নিজেই গুম নাকি তাকে কেউ গুম করেছে, তা তাঁর জানা নেই। তবে ইলিয়াস আলীর নামেও বিভিন্ন অভিযোগ ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি। এদিন দুপুরে র্যাব সদর দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর র্যাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি প্রথম মতবিনিময় করেন।
০৯ নভেম্বর শুক্রবার বিকালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে এক সমাবেশে স্বরাষ্টমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর যুবলীগ কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “যেখানেই জামায়াত–শিবির দেখবেন, সা¤প্রদায়িক শক্তির অপতৎপরতা দেখবেন সেখানেই তাদের প্রতিহত করবেন।” তবে সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই আহ্বানের জবাবে যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, “আমি কি ডিবিতে চাকরি করি নাকি। আমি তো রাজনীতি করি। জামায়াত–শিবির খোঁজা আমার কাজ না।’
গত ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবসে নূর হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ এরশাদকে আসতে বলেনি বা ডাকেনি, এরশাদ নিজেই এসে মহাজোটে যোগ দিয়েছেন। এভাবে কেউ যদি সমর্থন দেয় তাহলে তা গ্রহণ করা দোষের কিছু নয়।
শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ জামিনে মুক্তির বিষয়ে গত ১৬ ডিসেম্বর তিনি বলেন, জামিন পাওয়ার বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার। সব নিয়ম কানুন মেনেই বিকাশ জামিনে মুক্তি পেয়েছে। এদিন বিজয় দিবসে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে শহীদ স্মৃতি ফলকে পুস্পস্তবক অর্পণ শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, বিকাশ জামিনের মুক্তি পাওয়ার ব্যাপারে আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর কোন গাফলতি নেই।
১৮ ডিসেম্বর কয়েকটি বাম দলের হরতালকে অভিনন্দন নানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি বলেন, এ হরতাল সারাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে। রাজধানীতে একটি লেগুনার গ্লাস ভাংচুর ছাড়া অন্য কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। পুলিশ হরতালকারীদের সহযোগিতা করেছে। বিরোধীদল ইচ্ছা করলে এ হরতাল থেকে শিক্ষা নিতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মিডিয়া যা–খুশি লিখুক, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। তিনি এদিন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এ কথা বলেন।
গত ১৮ জানুয়ারি চাঁদপুরের কচুয়ায় তিনি বলেন, বিরোধীদলসহ বিভিন্ন সংগঠনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে ভাংচুর ও নৈরাজ্য বন্ধ করতে পুলিশ পিপার স্প্রে ব্যবহার করছে। বিক্ষোভ ঠেকাতে ফুলের মালা নয়, পিপার স্প্রে দিয়ে তাদের দমন করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
আর গত ২২ জানুয়ারি তিনি বলেন, ‘লালবাগের ডিসি হারুন–অর রশীদ সঠিক বিবেচনায়ই পিপিএম পদক পেয়েছেন। বিরোধী দলের চিফ হুইপকে মারার কারণে নয়। তবে সে ঘটনাটিও এ পদক প্রদানের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়েছে। তাকে নিরাবরণ করে ডিসি হারুন সঠিক কাজটি করেছেন। তার ওপর দায়িত্ব ছিল বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার। ওই দায়িত্ব হারুন কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করেছেন।’ এদিন দুপুরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশ সপ্তাহ–২০১৩ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে এক ব্রিফিংয়ে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর পুলিশের আলোচিত উপকমিশনার (ডিসি) হারুন–অর–রশিদের রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পাওয়ার ব্যাপারে এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
আর গত ২৯ মার্চ তিনি বলেছেন, ‘পুলিশের সামনে, নিরাপত্তা কর্মীদের সামনে যদি সাধারণ মানুষকে খুন করা হয়, তবে কি পুলিশ আঙুল চুষবে? পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এগুলো বন্ধ করার জন্য।’