আমাদের বুধবার প্রতিবেদন ::
অর্থনীতিবিদরা বলেন, উন্নয়ন হচ্ছে মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি। অর্থাৎ উন্নয়ন তাকেই বলা হয়- যা মানুষের কাজের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। যেমন পদ্মা সেতু নির্মিত হলে সংযুক্ত জনপদগুলোর জনগণের কর্মক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে । যদি এ সেতুর সংযোগ সড়ক না থাকে, তবে মানুষের কোনো সক্ষমতা বাড়বে না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, বিভিন্ন আমলে সড়কবিহীন শত শত সেতু গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছে যেগুলো শুধু অর্থ লোপাটের প্রতিমূর্তি। বিদ্যুৎবিহীন শত শত খাম্বার কথা ভাবুন। এসব তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রম মানুষের কাজের ক্ষমতা এক বিন্দুও বাড়ায়নি, বরং ক্ষেত্র বিশেষে ব্যাহত করেছে। তাই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো হতে হবে সঠিক জায়গায় ও মানুষের ব্যবহার উপযোগী। অমর্ত্য সেন ভারতবর্ষ ও বাংলাকে দিক নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, অর্থনৈতিক প্রগতি ও সর্বত্র সুষম উন্নয়নের জন্য মানবিক উন্নয়নই এ সময়ের অর্থনৈতিক প্রগতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবিক উন্নয়ন বলতে মানবসম্পদ, শিক্ষা, চিকিৎসা, পারিবারিক সক্ষমতা অর্জনকে বোঝাতে চেয়েছেন তিনি। আর নাগরিকের এ মৌল অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা দিতে হলে রাষ্ট্র ও সরকারকেই এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। এ বিষয়ে অমর্ত্য সেন বলেছেন, ভারতবর্ষ ও বাংলায় আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের মূলে রয়েছে দরিদ্র মানুষের মৌল অধিকার রক্ষায় সরকারের অপর্যাপ্ত ও লক্ষ্যভ্রষ্ট নীতি সহায়তা ও মন্থর উন্নয়ন কার্যক্রম। একইভাবে চতুর ও সুবিধাভোগী শ্রেণীর ঠগবাজি, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যবসার উত্থান এবং তা মানবিক উন্নয়নে ব্যবহার না হওয়া। বিশেষ করে শিক্ষা, চিকিৎসা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো মৌল কার্যক্রমগুলো অতিমাত্রার বাণিজ্যিক হয়ে পড়ায় তা সর্বসাধারণের কাছে দুর্লভ ও দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। অমর্ত্য সেন অর্থনৈতিক প্রগতির সঙ্গে মানবিক প্রগতির যোগসূত্র রয়েছে এমনটি স্বীকার করে নিয়েও জোড়ালোভাবে বলেছেন, বেসরকারি খাত দিয়ে কখনও মানবিক উন্নয়ন করা যায় না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলস্রোতে বেসরকারি খাত মুখ্য ভূমিকা রাখলেও মানবিক প্রগতির বিষয়টি কার্যত বেসরকারিখাতের নজরে অবহেলিতই থেকে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দরিদ্র মানুষের এসব অভাব পূরণে রাষ্ট্র কিংবা সরকার যদি তা উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা না রাখে কিংবা রাখলেও সেটি অপর্যাপ্তই থেকে যায়- তাহলে সমাজে বৈষম্য তৈরি করে।
অমর্ত্য সেন বলেন, বাণিজ্য বাড়লে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে। অর্থনৈতিক উন্নতি হলে বেসরকারি খাত সম্প্রসারিত হয়। বেসরকারি খাত বড় হলে মানুষের আয় বাড়ে। এতে ওইসব মানুষের দারিদ্র্য দূর হয়। যখন মানুষে সম্পদ পায় তখন সে উৎসাহিত হয়। এতে তার বিনিয়োগ প্রবণতাও বাড়ে। এর দ্বারা সরকারের রাজস্বও বাড়ে। এভাবেই অর্থনৈতিক প্রগতি ঘটে থাকে। অমর্ত্য সেন বলেন, মানবিক উন্নয়নের দিকে সরকারের নজর না থাকলে বাণিজ্যিক শিক্ষা, চিকিৎসা দিয়ে গণমানুষের চাহিদা পূরণ হয় না। এ ধরনের ব্যবস্থায় ধনীরা সেবা পেলেও, বঞ্চিত হয় গরিব মানুষ। কারণ বাণিজ্যিকীকরণের ফলে এসব সেবার মূল্য বাড়ে এবং সেটি সাধারণের সক্ষমতার বাইরে চলে যায়। তার মতে, এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকার যতই মনোযোগী হোক না কেন, তা একটা সময় স্থির হয়ে যেতে পারে। মানবিক উন্নয়নের খাতগুলোতে উন্নয়নের দৃষ্টি রাখতে হবে। আর সেটি সরকারকেই করতে হবে। বিশেষ করে দেশের সব নাগরিকের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসার সহজলভ্যতা এবং নারী উন্নয়নসহ মানব উন্নয়নের সর্বদিক নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।
ব্যক্তি, দেশ ও সমাজ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। সবার স্বপ্ন এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু সবাই সমান অগ্রগতি লাভ করতে পারে না। কেউ কেউ পিছিয়েও যায়। কে কি পরিমাণ আগোতে পারছে বা আদৌ পারছে কিনা, না পারলে কেন, এসব জানার দরকার পড়ে। দেশের অগ্রগতি পরিমাপের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু পদ্ধতি চালু হয়েছে। জাতীয় আয় বা জিডিপি মেপে কোনো দেশের অগ্রগতি বোঝার প্রচলিত পদ্ধতির ত্রু টি অনেক আগেই চোখে পড়ছে। চেষ্টা চলছে আরো ভালো পদ্ধতি বের করার যাতে একটি দেশের অগ্রগতি সঠিকভাবে বোঝা যায়। এ রকম প্রত্যেক চেষ্টার মূলে রয়েছে মানুষ অর্থাৎ মানুষের কল্যাণ ও সুখ।
অমর্ত্য সেন বলেছেন- জনসাধারণের সক্ষমতার নামই উন্নয়ন। তিনি মনে করেন, ‘মানুষের, সক্ষমতা নির্ভর করে, তার সত্বাধিকারের ওপর, অর্থাৎ কি পরিমাণ দ্রব্য এবং সেবা সামগ্রীতে সে তার স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে তার ওপর। মাথাপিছু কতটা খাদ্য পাওয়া যাবে অথবা মাথাপিছু মোট জাতীয় উৎপাদন কতটা এ ধরনের সাদামাটা নির্দেশকসমূহের ওপর যদি নির্ভর করা হয়, তাহলে অনাহার, ক্ষুধা এবং বঞ্চনার সামগ্রিক চেহারাটা উপলব্ধির পথে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। স্বত্বাধিকার নির্ধারণ ব্যবস্থা, সেই ব্যবস্থায় বিভিন্ন বৃত্তিভোগী কর্মগোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের অবস্থা, এ সবের সতর্ক বিশ্লেষণ আবশ্যক। তার মতে, উন্নয়ন আসলে মানুষের স্বাধীনতার চৌহদ্দি বাড়ানোর প্রক্রিয়া। মানুষ তার নিজের চাওয়া-পাওয়া কতদূল মেটাতে পারছে সে প্রশ্নটি উন্নয়নের সংজ্ঞায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
উন্নয়নের কথিত জোয়ারে, সবকিছু দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, ঐতিহ্যবাহী সমস্যাগুলির সঙ্গে যোগ দিচ্ছে নিত্য নতুন কৃত্রিম সমস্যা। উন্নয়নের নানা তত্ত্বে দেশ ভাসছে, চারিদিকে হৈ হৈ রই রই। অথচ প্রতিদিনই কমছে মানুষের স্বস্তি বোধ। সামাজিক সমস্যার রাষ্ট্রীয়করন এই প্রক্রিয়াকে আরো বেগবান করছে। ‘মাইন্ডসেট’ পরিবর্তনের হাজার এন্তেজাম তথাকথিত উন্নয়নের লক্ষ্য। কিন্তু যাদের উন্নয়নের জন্য এই যজ্ঞ তাদের অকথিত কথা কেউ শোনে না। উন্নয়ন সূচকের উর্ধগতি তত্ত্বেও দিনে দিনে গরীবরা আরো গরীব হচ্ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নাগরিক ভোগান্তি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রথাগত কয়েকটি সূচক হচ্ছে জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয়, মানব উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কল্যাণ। কোন দেশের জাতীয় আয় বাড়তে থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। যে কারণে মাথাপিছু আয়কে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক হিসাবে গ্রহণ করা হয়। সে হিসেবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অপেক্ষা জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার অধিক হলেই তাকে উন্নয়ন বলা যায়। জাতীয় আয়কে দেশের জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে প্রকৃত মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম মাপকাঠি মানব উন্নয়ন সূচক। মানব উন্নয়ন সূচকে মানুষের শিক্ষা, আয়ুষ্কাল, ক্রয় ক্ষমতা প্রভৃতি বিবেচনা করা হয়। তবে এই সূচকে জাতীয়ভাবে তথ্য নেওয়া হয়। কিন্তু ধনী-গরীব বৈষম্য, আঞ্চলিক বা গ্রাম ও শহরের বৈষম্য আমলে নেওয়া হয় না। ফলে এই সূচকে গণমানুষের প্রকৃত উন্নয়ন বোঝা যায় না।
নিম্নআয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশের নিম্নমধ্য আয়ের দেশে উত্তরণ ঘটেছে, এটি আমাদের জন্য একটি সুখবর অবশ্যই, যদি সত্য হয়ে থাকে। জনগণের গড় মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এতে সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমরা নানা স্বপ্নের জাল বুনতে পারি। তবে মনে রাখতে হবে, সেই স্বপ্ন পূরণে জাতীয় আয় বৃদ্ধি বা অর্থনীতির উচ্চ সূচকই যথেষ্ট নয়। দেখা দরকার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এর সুফল কতটা পাচ্ছে। জাতিসংঘের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মাত্র ১ শতাংশ মানুষ পৃথিবীর শতকরা ৪০ ভাগ সম্পদের অধিকারী। আর প্রাপ্তবয়স্ক ১০ শতাংশ বিত্ত-বৈভব ভোগ করছে পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ সম্পদ। এই যে ভয়াবহ বৈষম্য- এই জরিপে বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থারও প্রতিফলন রয়েছে। এদেশে আয়-বৈষম্য, সম্পদের মালিকানায় বৈষম্য, বিভিন্ন সেবাপ্রাপ্তিতে বৈষম্য এত প্রকট যে তা সাদা চোখেই দেখা যায়, গবেষণার দরকার হয় না। তবুও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন; গবেষণা হয়ও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক গবেষণা জরিপে বলা হয়েছে, দেশে নারী ও শিশুদের উন্নয়নে অনেক অগ্রগতি হলেও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এখনও প্রকট। ধনী পরিবারের একজন সদস্য যে সুবিধা পান, তার ছিটেফোঁটাও পান না দরিদ্র পরিবারের কেউ। জরিপে আরও বলা হয়েছে, আঞ্চলিক অবস্থান, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এখনও চ্যালেঞ্জের মুখে। অর্থাৎ বৈষম্য বড় সমস্যা, এটাই মূলকথা। দেশের গড় আয় বেড়েছে; কিন্তু আয় বৈষম্যের কারণে সমাজে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ, যে খাতগুলোর মাধ্যমে এই প্রবৃদ্ধি ঘটছে, তার বেশিরভাগ রয়েছে মূলত ধনী বা অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের অধিকারে। দরিদ্রদের নিজেদের সম্পদের পরিমাণ সামান্য। তাই আয় বৃদ্ধি ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির সুফল তারা পাচ্ছেন না। জনগণের জীবনমান উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় বৈষম্য। যেসব নীতি ও ব্যবস্থার ফলে সমাজে বৈষম্য কমে আসতে পারে, তা কখনও বাস্তবায়িত হয়নি। যেমন সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, শহর ও গ্রামের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনা।