হায়দার আকবর খান রনো ::
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের উপর সন্ত্রাসী হামলা, মন্দির ভাঙ্গা ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার পর এবার গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাওতাল পল্লীতেও একই ধরনের আক্রমণ করা হয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু অথবা আদিবাসী হবার কারণে যারা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের উপর এই রকম হামলা কিছুদিন পর পরই হচ্ছে। বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহল এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি, বিশেষ করে জমি দখলের জন্য এই ধরনের জঘন্য কাজে অগ্রসর হয়ে থাকে। রাষ্ট্রীয় মদদ অর্থাৎ সরকার দলীয় উচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি এবং প্রশাসনের সমর্থন বা কোন কোন ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া এই ধরনের ঘটনা বা মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনা ঘটতে পারে না। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে গঠিত এই দেশে এমনটি ভাবা না গেলেও এটাই এখন বাস্তব।
পাকিস্তানী ভাবাদর্শ-দ্বিজাতিতত্ত্বকে রাজনৈতিকভাবে ও সংস্কৃতিগতভাবে খন্ডন ও পরাভূত করা গিয়েছিল বলেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হতে পেরেছিল। কিন্তু এই মহান যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিল যে রাজনৈতিক দল-তারা সেই সময় জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হলেও তার সীমাবদ্ধতা যে ছিল, তা আমরা যারা সেই সময় যুদ্ধ করেছি, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। ’৭১-এর সংগ্রামের উত্তাপ থাকতে থাকতেই যে সংবিধান রচিত হয়েছিল, তাতে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে স্থান পেয়েছিল। কিন্তু সমাজতন্ত্রের কথাটা ছিল বিরাট বড় ধাপ্পা। জনগণকে বোকা বানানোর কৌশল। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা ? তদানীন্তন শাসকদল যে এই ব্যাপারেও খুব স্পষ্ট ও আন্তরিক ছিল না, তা তখনকার বেশ কিছু ঘটনাবলী দেখলেই বোঝা যাবে। আজকের প্রজন্ম অবশ্য সে সব কথা জানে না। কিন্তু আমার বয়েসী যারা, তারা তো চোখের সামনেই দেখেছে ঘটনাবলী।
তবু ’৭২-এর সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল। এটি ছিল একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা এসে নিজে মুক্তিযোদ্ধা হয়েও পাকিস্তানী ভাবাদর্শের সাথে আপোস করলেন, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ছেটে ফেললেন, সংবিধানকে ইসলামীকরণের উদ্যোগ নিলেন, মুসলিম লীগ, জামায়াতে প্রভৃতি দলকে রাজনীতি করার সুযোগ দিলেন এবং কাউকে কাউকে স্বীয় দলে ও মন্ত্রীসভায় স্থান দিলেন। এইভাবে রাষ্ট্রীয় প্ররোচনায় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা আবার ফিরে এলো। এরপর স্বৈরশাসক এরশাদ সংবিধানে যোগ করলেন ‘ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম।’ এরশাদের ভন্ডামির চূড়ান্ত পর্যায়। ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে গেল।
এরপর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই নানাভাবে ওই অপশক্তির সাথে আপোস করেছে। কথায় ও পোশাকে নিজেদের অধিকতর মুসলমান পরিচয় তুলে ধরতে তারা তৎপর। আওয়ামী লীগও যে এই আপোস ও আত্মসমর্পণের পথ নিয়েছিল তাও বহু ঘটনা দ্বারা দেখানো যাবে। কিন্তু বিএনপি, যার একদা মধ্যপন্থী দল হিসাবে পরিচয় ছিল, সেই বিএনপির অধঃপতন ঘটেছিল অনেক বেশি ও দ্রুততর। জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ বিএনপি এখন পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগেরও রূপান্তর ঘটেছে। একদা যেটুকু জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ কাজ করতো, এখন তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আওয়ামী নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনীর মধ্যে কোন আদর্শবোধ কাজ করে না। টেন্ডারবাজী, মাস্তানী, বেপরোয়া লুটপাট, রাষ্ট্রীয় সম্পদ দখল, নদী দখল, পরের জমি দখল এবং লুটপাটের ভাগ নিয়ে নিজেদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ, যার পরিণতিতে নিজেদের লোকও যেমন প্রতিনিয়ত খুন হচ্ছে, তেমনি মায়ের পেটের শিশুও গুলিবিদ্ধ হয়। এই সবই এখন শাসক দলের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য। দখল করার প্রবৃত্তি যেখানে প্রধান সেখানে সবচেয়ে দুর্বল অংশের জমি সম্পত্তি দখল করার আকাঙ্খা থাকবে না কেন? সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাবে-এই তীব্র আকাঙ্খাই কাজ করেছে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারাকাতের এক গবেষণাপত্র থেকে জানা যায় যে, অর্পিত সম্পত্তির নামে যে সকল হিন্দু সম্পত্তি দখল করা হয়েছে, তার ৬০ শতাংশ করেছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপির স্থানীয় নেতাদের নেতৃত্বে কয়েকটি জায়গায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী কারবার চালানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ভয় দেখিয়ে হিন্দুদের দেশত্যাগ করানো। কারণ হিন্দুভোট আওয়ামী লীগের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে আছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ভাবে, হিন্দুরা দেশে থাকলে ভোটটা নিশ্চিত, আর দেশত্যাগ করলে জমিটা দখল করা যাবে।
নাসিরনগরের ঘটনায় শাসক দল যে জড়িত তার বহু প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। জনৈক মন্ত্রী ও জনৈক সংসদ সদস্য হিন্দুর প্রতি বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলেছেন, অসভ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন- এমন অভিযোগও আছে। ইতোপূর্বে রামুর ঘটনাতেও আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে সকলেই জড়িত ছিল। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাহরিয়ার কবির বলেছেন, গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগের জামায়েতীকরণ হয়েছে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত অভিযোগ করেছেন, ‘গত কয়েক বছরে সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলায় আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতাকর্মীকে অংশ নিতে দেখা গেছে।’ তিনি বলেন, ‘সরকারি দলের লোকরা যদি এ ধরনের হামলায় জড়িত হয়, তাহলে এই দেশে হিন্দুরা আর বেশিদিন থাকতে পারবে না।’
দেখা যাচ্ছে হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করার ক্ষেত্রে বড় দুটি দলেরই স্বার্থ রয়েছে। বিএনপির ক্ষেত্রে ভোটের হিসাব। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে জমি দখলের আকাঙ্খা।
হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাধারণ মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তোলার সহজ উপায় হল, ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে এমন অভিযোগ আনা। নাসিরনগরের ক্ষেত্রেও দেখা গেল একজন নিরীহ গরিব হিন্দুর বিরুদ্ধে এমনই ভুয়া অভিযোগ তোলা হলো। সেই ব্যক্তিকে গ্রেফতারও করা হলো। তারপরও হিন্দু বাড়িঘরে আক্রমণ করা হলো। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ছিল সন্দেহজনক। শাসক দল, প্রশাসন ও মৌলবাদী শক্তি-সবাই একত্রে হলে তো আসলেই পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
কিছুদিন আগের আরেকটি ঘটনার কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে। শাসকদের স্নেহধন্য নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের সদস্য ও সংসদ সদস্য তার লোকজন নিয়ে জনৈক হিন্দু শিক্ষককে কানধরে উঠবস করিয়েছিলেন। অভিযোগ, উক্ত শিক্ষক নাকি ইসলামবিরোধী বক্তব্য রেখেছেন। হিন্দু নাগরিককে শায়েস্তা করার জন্য এর চেয়ে শস্তা ও সহজ উপায় আর কি আছে।
আমরা দেখলাম, সারাদেশের প্রগতিশীল মানুষ শিক্ষকের পক্ষে দাড়িয়েছিল। কিন্তু ওসমান পরিবারের পক্ষে দাড়িয়ে হিন্দু শিক্ষকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, সভা করে চরম সাম্প্রদায়িক বক্তব্য রেখেছিল হেফাজতে ইসলাম। কি চমৎকারভাবে মৌলবাদী হেফাজত ও শাসক আওয়ামী লীগ একত্রে মিলে গেল একজন হিন্দু শিক্ষককে মিথ্যা অপবাদে অভিযুক্ত করার ও অপমাণিত করার ক্ষেত্রে। অথচ ২০১৩ সালে এই হেফাজতকে দিয়ে খালেদা জিয়া সরকার পতনের ও ইসলামী অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন।
এখন শ্রেণী স্বার্থে সবাই এক কাতারে দাড়িয়েছে। লুটপাট যেখানে শ্রেণী বৈশিষ্ট, সেখানে বুর্জোয়া দলগুলোর মধ্যে কোন ফারাক থাকছে না। এই একই কারণে শাসক আওয়ামী লীগ সংবিধানে বড় বড় পরিবর্তন আনলেও এরশাদের অবদান ‘ইসলাম রাষ্ট্র ধর্ম’কে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এক সভায় মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন অভিযোগ করেছেন, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে রাজনীতি। ওই সংবিধানে ফিরে না গেলে রামু, সাথিয়া ও নাসিরনগরের মতো সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’
বলাই বাহুল্য, এটা মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কথা। সরকারের ভাষ্য নয়। যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বলে দাবিদার, সেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দল ও প্রশাসনের মদদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়, তা ভাবতেও বিস্মিত হতে হয়। যে আওয়ামী লীগের রিজার্ভ ভোট হল হিন্দু নাগরিকগণ, সেই আওয়ামী লীগের লোকজন হিন্দুর বাড়িঘর, মন্দিরের হামলা চালায়, অগ্নিসংযোগ করে, হিন্দুবিদ্বেষী বক্তব্য দেন, এটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য। কারণ সবার উপরে শ্রেণী সত্য। আওয়ামী লীগ এখন যে শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে সেই শ্রেণী কোন উৎপাদক শ্রেণী নয়, তাহলো নিকৃষ্ট ধরনের লুটেরা বুর্জোয়া। আর লুটপাট করার সহজ টার্গেট হলো ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী।
বাংলাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করতে হলে নির্ভর করতে হবে বামশক্তির ওপর। নাসিরনগরের ঘটনা এই শিক্ষাটি আরেকবার তুলে ধরলো।