ফরেন পলিসি থেকে
অনুবাদ : মোহাম্মদ হাসান শরীফ
রাজা না হয়েও পল বিয়ার বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সময় ধরে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বহাল থাকাটা কাকতালীয় কোনো ব্যাপার নয়। তিনি ক্ষমতায় আছেন ৩৬ বছর ধরে, এখন সপ্তম মেয়াদের জন্য ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেশকে ‘‘পরিচালনার’’ করার আসল ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছেন। সাংবিধানিক পরিষদ তাকে ক্ষমতায় রেখেছে, বিষয়টি এমনও নয়। তিনি রীতিমত ‘‘নির্বাচনে জিতে’’ তবেই ক্ষমতার মসনদে আছেন!
বিদেশী পর্যবেক্ষকদের মতে, যেকোনো বস্তুনিষ্ঠ মানদন্ডেই গত ৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ক্যামেরুনের নির্বাচন ছিল প্রহসনমূলক। ভোটারদের উপস্থিতি ছিল ভয়াবহ রকমের কম। বিশ্বাসযোগ্য সূত্রগুলো জানিয়েছে, ভয়ের কারণে কোনো কোনো এলাকায় এক শতাংশেরও কম ভোটার ভোট দিয়েছেন। ইংরেজি ভাষাভাষী অঞ্চলে কথিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর পরিচালিত কঠোর দমন অভিযানের ফলে অনেক ভোটকেন্দ্র বন্ধ থাকে, বাকিগুলোতে মূলত সৈন্যদেরই উপস্থিত থাকতে দেখা যায়।
তবে ওই দেশের রাষ্ট্রীয় মিডিয়া আপনাকে জানাবে, নির্বাচন হয়েছে চমৎকার। আর তাদের বক্তব্যের সমর্থনে ’বাইরের পর্যবেক্ষকদের’ উদ্ধৃতিও দিয়ে হলেও প্রমাণ করতে চাইবে, নির্বাচন হয়েছে অবাধ, নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ।
গত ৮ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ক্যামেরুন রেডিও ও টেলিভিশন (সিআরটিভি) একদল আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের সাক্ষাতকার প্রচার করে। এতে তারা দেশটির নির্বাচনের প্রশংসা করে একে বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠু বলে অভিহিত করেন। সিআরটিভিতে প্রদর্শিত ট্রান্সপেরেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নুরিট গ্রিনজার নামে অভিহিত এক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ক্যামেরুনের নির্বাচনকে ’চরমমাত্রার সুষ্ঠু’ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এখানকার ব্যবস্থা প্রতারণা করার কোনো পথ ছিল বলে আমি কল্পনাও করতে পারি না।’
তবে এখানে একটু জটিলতা আছে বৈকি; ট্রান্সপেরেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ক্যামেরুনে কোনো নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাঠায়ইনি। আর সিআরটিভিতে যাকে দেখা গেছে, তার সাথে গ্রুপটির কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছে খোদ ট্রান্সপেরেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। ট্রান্সপেরেন্সি’র মুখপাত্র মাইকেল হর্নসবে বলেন, ট্রান্সপেরেন্সি ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের সদস্য হিসেবে পরিচয় দানকারী এই লোক কে, তা নিয়ে রহস্য রয়েই গেছে। সংগঠনটির মুখপাত্র ফরেন পলিসিকে বলেন, তবে আমি মনে করি, বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রকাশ করার পরও এক লোক বারবার বলছেন, তিনি আমাদের প্রশিক্ষিত লোক।
অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনকে বৈধতার রঙ দিতে স্বৈরশাসকরা নতুন পদ্ধতি হিসেবে এই আশ্চর্য ব্যবস্থাটিকেই ক্রমবর্ধমান হারে ব্যবহার করছে। বহিরাগতদেরকে ব্যবহার করার এই বিশেষ কৌশলটি এখন দুনিয়াজুড়ে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
আবার গণতন্ত্রী হিসেবে ভান করা দুনিয়ার সব স্বৈরাচারের মধ্যে পল বিয়া অন্যতম কড়িৎকর্মা। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তিনি অন্যান্যবারের চেয়ে এবার বেশি ভুল করেছেন, কিন্তু তাতে তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল থাকতে কোনো ব্যাঘাত ঘটাবে না।
আফ্রিকায় গণতন্ত্র বিকাশে নিয়োজিত অমুনাফামূলক সংস্থা ‘ভ্যানগার্ড আফ্রিকা’র নির্বাহী পরিচালক জেফরি স্মিথ বলেন, ক্যামেরুন ও অন্যান্য স্থানে সত্যিকার অর্থে যা ঘটছে তা অতি মাত্রায় অবমাননাকর, দমনমূলক। আর স্বৈরতান্ত্রিক শাসকেরা অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার কাজটি কোনো না কোনোভাবে করে নেবে।
এই কৌশলের মধ্যে যে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য প্রধান শক্তি যাতে বিব্রতকর হওয়ার মতো কোনো অবস্থায় না পড়ে, সে দিকে নজর রাখা হয়। বিয়ার এলাকাটি ছোট হলেও অত্যন্ত শক্তিধর লবিং গ্রুপ আর গণসংযোগ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাইরের দুনিয়ার কাছ থেকে মর্যাদা কেনার প্রয়াসে তাদেরকে নিয়োগ করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান দেশটির মিডিয়া ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করে, মার্কিন আইনপ্রণেতাদের সংস্পর্শ বজায় রাখে।
ক্যামেরুনে ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রথম নারী প্রার্থী কাহ উল্লাহ তার দেশকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি ফরেন পলিসিকে বলেন, ‘‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রের বিষয়টি মাথায় রেখেই ক্যামেরুনের বিরোধী দল বাস্তবে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি, তার দল, আমলাতন্ত্র, রাষ্ট্রীয় মিডিয়া ও এমনকি বেসরকারি মিডিয়ার বেশির ভাগের (যেগুলো দলের ক্যাডার আর সশস্ত্র বাহিনী পরিচালনা করে) বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তিনি বলেন, ভোটের দিন আমাদের দলের প্রতিনিধিদের ভোটকেন্দ্রগুলো থেকে বের করে দেওয়া হয়। এছাড়া হুমকি, ঘুষ প্রদানের ব্যাপার তো রয়েছেই। বিরোধী দল হিসেবে আমাদেরকে সারাক্ষণ ভোটকেন্দ্রগুলোর পাশে ধাওয়ার শিকার হতে হয়’’।
ক্যামেরুনের সাংবিধানিক পরিষদ নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ জানানোর জন্য ৭২ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েছিল। এই পরিষদের সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান পল বিয়া। আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণার আগেই পরিষদের সদস্যদের অভিযোগ শোনার কথা ছিল। কিন্তু তারা প্রার্থীদের তাদের দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ দাখিলের সুযোগ না দিয়েই চলে যান।
ক্যামেরুনের উচ্চমর্যাদার অ্যাংলোফোন মানবাধিকার আইনজীবী এনকোনখো ফেলিক্স অ্যাগবোর বাল্লা অতিসম্প্রতি সাংবিধানিক পরিষদে বলেন, যেকোনো নির্বাচনী চ্যালেঞ্জেই আসুক না কেন, রায় যাতে পল বিয়ার পক্ষে যায় সে ব্যবস্থা তিনি করে রেখেছিলেন। তিনি ফরেন পলিসিকে বলেন, বিচারকেরা যার ওপর নির্ভরশীল, তাকে তো আর ক্ষেপাতে পারে না, তারা তাদের প্রভূর বিরুদ্ধে যেতে পারে না। এসব লোক কখনোই বিয়াকে নির্বাচনে হারতে দেবে না।
বিয়া বছরের পর বছর ক্ষমতায় রয়েছেন তার সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জার এলিটদের কাছে টেনে, বিভক্ত বিরোধীদের দুর্বল করে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে- যারা নির্বাচন নজরদারি করে, তাদের নতজানু করে।
সহিংসতা ও দীর্ঘ দিনের বেপরোয়া দুর্নীতি ক্যামেরুনের অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিয়া তার পুনঃনির্বাচনের জন্য প্রধান প্রধান যুক্তি হিসেবে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকানের মতো প্রতিবেশীদের তুলনায় তার দেশের স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাব-সাহারিয়ান আফ্রিকা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ নাটালি লেতসা বলেন, দশকের পর দশক ধরে বিয়া তার নির্বাচনী প্রচারণায় বলে আসছেন, আমাদের প্রতিবেশীদের দিকে তাকান, নাইজেরিয়াকে দেখুন, কী বিশৃঙ্খলা চলছে। আমরা স্থিতিশীল, আমরা ঐক্যবদ্ধ। আমরা গর্ব করার মতো শক্তিশালী দেশ।
তিনি বলেন, যেসব তথ্য সম্পর্কে দেশবাসী সহজে জানতে পারে না, সেগুলোই বিয়ার সরকার তোতাপাখির মতো আউরিয়ে যাচ্ছে।