সাইদুল ইসলাম
ভারতের সাথে রাশিয়ার বোঝাপড়া বাড়ছে। দুদেশের সম্পর্ক দিন দিন আরো উন্নত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে ভারত এবং রাশিয়ার সঙ্গে বিপুল অর্থের অস্ত্র ক্রয় চুক্তির পর আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এমন ধারনা করছেন। রাশিয়া থেকে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য গত ডিসেম্বরে ভারত চারশ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি করেছে। চুক্তিটি এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ অংকের। তবে শুধু ভারতের কাছেই নয়, একমাত্র পাকিস্তান ছাড়া এশিয়ার অনেক দেশেই রাশিয়া অস্ত্র বিক্রি করছে। ভারতের সঙ্গে মিলেমিশে দেশটি এশিয়া অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য নতুন একটি ক্ষেত্র তৈরী করতে যাচ্ছে বলেও খবরে প্রকাশ পেয়েছে।
প্রতিরক্ষা খাতে রাশিয়ার সাথে ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। প্রতিরক্ষা খাতে ভারত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যে সম্পর্ক তৈরী করেছিলো,তা সোভিয়েত ভেঙে যাবার পর তা এখন আরো জোরদার হয়েছে। একসময় শুধু যুদ্ধাস্ত্র কেনা–বেচার মধ্যে এ সম্পর্ক সীমাবদ্ধ থাকলেও, এখন তা গড়িয়েছে আরো বহুদুর। যৌথ গবেষনা, উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষনের ক্ষেত্রেও এ সম্পর্ক এখন বিস্তৃত হয়েছে। এমনকি দুটি দেশের সেনাবাহিনী এখন যৌথ মহড়াও চালাচ্ছে। শুধু প্রতিরক্ষাই নয়, রাশিয়ার সাথে ভারতের সম্পর্ক রাজনৈতিকভাবেও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ঠান্ডা যুদ্ধ চলাকালীন সময়েও ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কৌশলগত, প্রতিরক্ষা, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেংগে যাবার পরও রাশিয়া ভারতের সাথে সে সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটলেও তা ওই দুদেশের সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারেনি।
ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্কের নতুন মাত্রা পেতে থাকে ১৯৫০ সাল থেকে। এসময় সোভিয়েতরা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হয়ে উঠে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত সফর করেন। একই বছর সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ক্রুশ্চেভ ভারত সফর করেন। এসময় সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট একটি ঐতিহাসিক ঘোষনা দেন। তিনি কাশ্মীর অঞ্চলকে ভারত শাসিত বলে উল্লেখ করেন। এমনকি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে গিয়ে চীনের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কও প্রায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো। ১৯৬২ সালে ভারত এবং চীন সীমান্ত বিরোধ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার নিরপেক্ষ ভূমিকার কথা জানায়। এ ঘটনা চীনেকে মর্মাহত করে। ক্রুশ্চেভ সরকারের সময় সোভিয়েত এবং ভারতের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং সামরিক সহায়তা সম্পর্ক দুর্দান্ত রূপ লাভ করে। ১৯৬০ সালে সোভিয়েত থেকে চীন যে পরিমান সহায়তা পেতো, ভারত পেতো তার চেয়ে বেশি। ১৯৬২ সালে মিগ–২১ যুদ্ধবিমান তৈরীর ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে প্রযুক্তি সরবরাহে রাজি হয়। চীন এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে এ প্রযুক্তি চাইলে তারা তা দিতে সম্মত হয়নি।
ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৬৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন দুদেশের সাথে মধ্যস্থতা করে যুদ্ধ থামাতে সমর্থ হয়। এসময় সোভিয়েত হক্ষক্ষেপে কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ভারত এবং পাকিস্তান নিবৃত্ত হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত এবং রাশিয়ার সম্পর্ক আরো জোরদার হয়। চীন যাতে এ যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে সে লক্ষ্যে সোভিয়েতের তৎরপরতা ছিলো চোখে পড়ার মতো।
ভারতে সরকার বদল হলেও সোভিয়েতের সাথে দেশটির সম্পর্ক কোন সময়ে খারাপ যায়নি। এমনকি ৭০ এর দশকের শেষের দিকে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের সময়েও ভারত–সোভিয়েত সম্পর্ক উষ্ণ ছিলো। আশির দশকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিহত হবার পরও ভারত–সোভিয়েত সম্পর্কে ফাটল ধরেনি। ইন্দিরা গান্ধীর পূত্র রাজীব গান্ধী ক্ষমতায় এসেই এ সম্পর্ক ধরে রাখতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজীব গান্ধী প্রথম বিদেশ সফরে যান সোভিয়েত ইউনিয়নে। এ সফরে সোভিয়েতের সাথে ভারতের দুটি দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সহায়তা চুক্তি সাক্ষরিত হয়। ১৯৮৬ সালে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচেভ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সফর শুরু করলে প্রথমে তিনি আসেন ভারতে। এসময়ে তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক বিষয়ে আলোচনা করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন চেয়েছিলো এশিয়ায় একটি সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। এ ব্যবস্থা তৈরী করার লক্ষ্যে রাশিয়ার তৎপরতা এখনো অব্যাহত আছে বলে অনেক বিশ্লেষকের ধারনা। দক্ষিন এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্কের পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগ দিতে ইতিমধ্যে রাশিয়া আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ উদ্যোগকে এশীয় অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব বাড়ানোর কৌশল হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। ভারতের সঙ্গে নিয়মিতভাবে সামরিক মহড়া চালিয়ে এ অঞ্চলে রাশিয়া তার প্রভাবের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এসব মহড়া ভারতের মাটিতে যেমন হচ্ছে পাশাপাশি রাশিয়াতেও হচ্ছে। আকাশ, স্থল ও নৌবাহিনীর এসব মহড়া গত কয়েকবছরে নিয়মিত হয়েছে।
গত ডিসেম্বর মাসে ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সাড়ে সাতশ কোটি মার্কিন ডলারের অস্ত্রচুক্তি দুদেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা বন্ধুত্বের নতুন দিগন্ত উম্মোচন করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভাদিমির পুতিন নিজেই নয়াদিল্লিতে উপস্থিত থেকে এ চুক্তি সাক্ষর প্রত্যক্ষ করেছেন। ছয় বছরের জন্য নতুন করে ক্ষমতা নেয়ার পর পুতিনের নয়াদিল্লি সফরকে দুদেশের সম্পর্ক নবায়ন হিসেবে দেখেছেন অনেকে। পুতিন ভারত সফরে আসার পর মনমোহন সিং তাকে ‘ভারত–রাশিয়ার কৌশলগত সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নতুন সমরাস্ত্র চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া ভারতকে সাড়ে সাতশ কোটি মার্কিন ডলারের যুদ্ধবিমান এবং এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিন সরবরাহ করবে। এছাড়া, ওই চুক্তিতে হেলিকপ্টার সরবরাহসহ নানা ধরণের যন্ত্রপাতি সরবরাহেরও কথা রয়েছে।
বর্তমানে রাশিয়ার বিভিন্ন সমরাস্ত্র ভারত নিজেরাই তৈরী করছে। ব্রামোস সুপারসনিক মিসাইল, টি–৯০ ট্যাংক এবং সুখৌ যুদ্ধবিমান অন্যতম। আর রাশিয়াই একমাত্র দেশ যারা শুধুমাত্র ভারতের সাথে সমরাস্ত্র প্রযুক্তি বিনিময় করছে। পৃথীবির আর কোন রাষ্ট্র এ কাজটি করছে না। রাশিয়ার প্রযুক্তি দিয়ে ভারত এয়ারক্রাফট এবং নিউক্লিয়ার সাবমেরিন তৈরী করছে। এটাও উল্লেখযোগ্য যে, রাশিয়াই একমাত্র দেশ যারা পাকিস্তানের কাছে সামরিক প্রযুক্তি বিক্রি করে না।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারত এবং রাশিয়ার বন্ধুত্ব সাম্প্রতিককালে উন্নত হবার আরেকটি কারণ হলো, আফগানিস্তান পরিস্থিতির অবনতি। মস্কো জোরালোভাবে বিশ্বাস করে যে, আফগানিস্তানের অবনতিশীল পরিস্থিতি ভারত এবং রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে পশ্চিমা সৈন্যরা চলে গেলে সেখানকার পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে– তা নিয়েও উদ্বিগ্ন দুদেশ। ইতিমধ্যে তারা আফগানিস্তানের বিষয়ে নতুন নীতি তৈরীর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এখানে উল্লেখ্য, ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা এবং এ লক্ষ্যে বেশ কিছু কার্যক্রমও তারা গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই সম্পর্কের কারণেও ভারত–রাশিয়ার সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বরং এই সম্পর্ক ভালোভাবেই বিদ্যমান আছে।
তবে শুধু ভারতের সঙ্গেই নয়, এশিয়ার অনেক দেশ বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করতে চায় রাশিয়া। কৌশল হিসেবে ব্যবসা বানিজ্য এবং অস্ত্র সরবরাহ বাড়ানোর নীতি অনুসরণ করছে দেশটি।।