এম. জাকির হোসেন খান
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশব্যাপী ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সহিংসতার ফলে উদ্বেগ প্রকাশ করে আশংকা প্রকাশ করছে যে, ‘২০১৪ এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ‘ডেসট্রাকটিভ ব্রিঙ্কম্যানসশিপ’বা বিপজ্জনক নীতি অনুসরণ করার ফলে রাষ্ট্রটি খাদের কিনারায় পৌঁছানোর ন্যায় অবস্থা আবার ফিরে আসতে পারে। বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের মধ্যকার মতভেদ শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে ব্যর্থ হওয়ায় রাজনৈতিক সহিংসতা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়া খুবই উদ্বেগজনক। আমরা খুবই উদ্বিগ্ন যে, ব্যাপক সহিংসতার ফলে ইতিমধ্যে অনেক মৃত্যু, আহত হওয়া এবং বিপর্যয় ঘটেছে এবং পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করেছে। আমরা সকল রাজনৈতিক দলের কাছে আবেদন করছি – তারা যেন সহনশীল আচরন করে এবং দ্রুত এ গোলযোগের পরিসম্পাপ্তি ঘটে। সকল হত্যাকান্ডের সাথে সরকার বা সরকারের বাইরে যেই জড়িত থাকুক না কেন, আমরা চাই কর্তৃপক্ষ দ্রুত এসবের নিরপেক্ষ এবং কার্যকর তদন্ত নিশ্চিত করবে। একই সাথে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে বিরোধী দলের প্রধান নেতৃবৃন্দের সকল গ্রেফতার এবং ডিটেনশন প্রদানে যেন স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় না নেয়া হয় এবং আইন শৃংখলা রক্ষায় গৃহীত পদক্ষেপে যেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লংঘন না ঘটে– যার আওতায় শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ, চলাফেরা এবং বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে’। গত ১৬ জানুয়ারি জেনেভাভিত্তিক জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন প্রকাশিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে বাংলাদেশে চরম মানবাধিকার লংঘনের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এভাবেই হুশিয়ারি প্রদান করে। এ বিবৃতিতেও ২০১৩ এর মতো সুনির্দিষ্টভাবে ‘ডেসট্রাকটিভ ব্রিঙ্কম্যানসশিপ’কথাটি পুনরায় উল্লেখ করা হয়।
উল্লেখ্য, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতার প্রাক্কালে ২০১৩ এর ১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের মত–বিরোধ যাই থাকুক না কেন তা দূরে রেখে, ধ্বংসাত্মক নীতি পরিহার করে, দেশকে খাদের কিনারে যাওয়া থেকে রোধ করা এবং একইসাথে চলমান অস্থিরতাকে আলোচনার মাধ্যমে চলমান সংকটকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে তাদের প্রভাবকে কাজে লাগানোর আবেদন করছি। এ ধরনের সহিংসতা বাংলাদেশের জনগণের জন্য গভীর পীড়াদায়ক, যাদের অধিক সংখ্যক চায় এবং একটি শান্তিপূর্ণ,অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন তাদের প্রাপ্যও। বিরোধী দলের নেতাদের চলমান গণ–গ্রেফতার এবং ডিটেনশন পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাবে এবং প্রধান দলগুলোর মধ্যে অংশগ্রহণ, সহযোগিতা এবং আলোচনার সম্ভাবনা নস্যাৎ করবে। অন্য রকম পরিস্থিতিতে, আমরা দেখেছি যে, রাজনৈতিক বা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সহিংসতায় অপরাধে জড়িত যার মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও জড়িত থাকতে পারে–বিচারের সম্মুখীন হয়েছে’। সর্বশেষ ১৬ জানুয়ারির বিবৃতিতেও জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি স্পষ্ট করে বাংলাদেশের বিবদমান দলগুলোকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, গভীরতর রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে হত্যাকান্ডের সংখ্যা বাড়তে থাকলে এর দায় তারা এড়াতে পারবেন না। অর্থাৎ জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই পর পর দু’বার রাষ্ট্রের সকল পক্ষগুলোকে মনে করিয়ে দেন যে, ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সংক্রান্ত রোম চুক্তির একটি পক্ষ’। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের তরফে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে এ ধরনের হুঁশিয়ারি এই প্রথম ঘটলো। ২০০৭ সালে কেনিয়ায় নির্বাচন–পরবর্তী সহিংসতায় এক হাজারের বেশি নাগরিকের মৃত্যুর দায়ে বর্তমান কেনীয় প্রেসিডেন্ট ও ডেপুটি প্রেসিডেন্টও হেগের আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে বিচারের সম্মুখীন হচ্ছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সর্বশেষ বিবৃতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের জন্য বিশেষ বার্তা– যা ২০১৪ এর ৬ জানুয়ারিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতির ধারাবাহিকতা মাত্র।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের পরদিন (৬ জানুয়ারি) জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ‘গত কালের একপাক্ষিক এবং নিম্ন অংশগ্রহণের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রাণহানি এবং সহিংসতার ঘটনায় মহাসচিব দু:খিত। তিনি দু:খ প্রকাশ করে বলেন, বিবাদমান দলগুলো কোনো ধরনের মতৈক্যে পৌছতে ব্যর্থ না হলে একটি শান্তিপূর্ণ, সকলের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হতো। তিনি সকল পক্ষকে আত্মসম্বরণের চর্চা এবং প্রথমে ও অবশ্যই একটি শান্তিপূর্ণ এবং সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতের আহবান জানান, যাতে জনগণ সমাবেত হওয়া এবং বাক স্বাধীনতার অধিকার চর্চা করতে পারে। জনগণ এবং সম্পদের ওপর সহিংস আচরণ এবং আক্রমণ কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মহাসচিব রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থপূর্ণ আলোচনা শুরু এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানান। অংশগ্রহণমূলক, অহিংস, সমঝোতাপূর্ণ এবং আলোচনার নীতির ভিত্তিতে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রাখতে জাতিসংঘের সহায়তা অব্যাহত থাকবে’। জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগে বিবাদ নিরসনে ব্যর্থ হওয়ার প্রাক্কালে ক্ষমতাসীনরা নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের পর সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচনের যে ওয়াদা সরকার জাতিসংঘকে দিয়েছিলো, এ বিবৃতির মাধ্যমে তা মনে করিয়ে দেওয়া হয় এবং তা করতে ব্যর্থ হলে জাতিসংঘ যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে পিছপা হবেনা– তা জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের বিবৃতিতে স্পষ্ট হয়েছে। অবশ্য সর্বশেষ এ বিবৃতির পরও সরকার জাতিসংঘের সাথে প্রতিশ্রুতি লংঘন করে ২০১৯ সালের আগে কোন নির্বাচন না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে বিবাদমান দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার লক্ষে জাতিসংঘ সহকারি মহাসচিব অস্কার ফার্নান্ডেজ তারানকো ২০১৩ এর ৬ থেকে ৯ ডিসেম্বর ধারাবাহিকভাবে প্রধানমন্ত্রী, সরকার ও বিরোধী দলের সাথে দফায় দফায় এককভাবে, আবার যৌথভাবে সভায় বসলেও কোনো সমঝোতা ছাড়াই মিশন সমাপ্ত হয়। এ অবস্থায় জাতিসংঘ বা বিশ্ব নেতৃত্ব কি ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাই দেখার বিষয়।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সকলের অংশগ্রহণে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সরকার কর্তৃক বিরোধী মতাবলম্বীদের হত্যা, নির্যাতন বন্ধ করা এবং সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের আহবান জানালেও সরকার কর্ণপাত করেনি। ভয়েস অব আমেরিকা’র ২০১৩–এর ২৮ ডিসেম্বর ‘ইলেকশনস ইন বাংলাদেশ’শীর্ষক সম্পাদকীয়তে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র জেন পসাকি’র বিবৃতিতে বলা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্র হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করছে যে, ৫ই জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন প্রার্থীরা। এ অবস্থায় অবাধ ও মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এখনও বড় রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতায় আসেনি। এর প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে কোন পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। পরবর্তীতে অধিকতর উপযোগী পরিবেশে এ প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ফের যুক্ত হতে প্রস্তুত। সহিংসতা ও ভয়ভীতি মুক্ত পরিবেশে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার রাখেন বাংলাদেশের জনগণ। সব দল ও নাগরিকদের অবাধে ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের অধিকার আছে এবং সে সুযোগ করে দিতে দায়বদ্ধ সরকার’। উল্লেখ্য, ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের প্রাক্কালে ৩ জানুয়ারি ২০১৪ মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি মুখপাত্র ম্যারি হার্ফ বলেছিলেন, ‘পরিষ্কার করেই আমি যেমনটা বলেছি যে তারা (ক্ষমতাসীন সরকার) অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের কোন পদক্ষেপ নেয়নি’। হয়তো সরকারের আশা ছিলো টিকফা চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারকে সমর্থন করবে, কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র আগের অবস্থানে বহাল থাকায় ক্ষমতাসীনরা কূটনৈতিক সীমা লংঘন করে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দু’আনার মন্ত্রী এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রদুত মজিনাকে কাজের লোক মর্জিনা বলে উপহাস করে।
২০১৪’র ৩ জানুয়ারি ভারতের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতা সুব্রামানিয়াম স্বামী বলেন, ‘প্রয়োজনে অন্যান্য দেশের সহযোগিতায় বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে হয় সেজন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আরও অতিরিক্ত পথ হাঁটতে হবে। ভারত সরকারের গুরুত্ব¡পূর্ণ কাজ হলো ২০১৪ সালের সংসদীয় নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে যাতে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তর হয় তা নিশ্চিত করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখা’।
সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে ক্যাথেরিন অ্যাশটন মন্তব্য করেন, ‘জাতিসংঘের উদ্যোগ সহ অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো স্বচ্ছ, সবার অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণে সক্ষম হয়নি’। এ প্রেক্ষিতে সজীব ওয়াজেদ জয় ইইউ’র সমালোচনা করে বলেন, ‘তাদের আজকের বিবৃতিতে বুঝা যায়, তারা আবার বিএনপি জামায়াতের পক্ষ নিচ্ছে। জামায়াতের পক্ষ নিয়ে ইইউ এখন দাবি করছে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। শুধুই বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হচ্ছে কি হচ্ছে না, বিদেশিরা নয়।’অথচ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীনরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তদবির করেও যখন স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়নি, তখন এসব দেশের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা এবং একপাক্ষিক নির্বাচন হলে এর পরিণাম সম্পর্কে ২০১৩ এর ২১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী পত্রিকা ‘ইকোনমিস্ট’মন্তব্য করে যে, ‘ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনে জিতবে আর হারবে বাংলাদেশ’। বিখ্যাত ‘ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন’২০১৩’র ৩০ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংখ্যায় বলা হয় ‘রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ ২০১৪ সালে প্রবেশ করল। দেশটিতে একদিকে জানুয়ারি মাসের নির্বাচন এগিয়ে আসছে, অপর দিকে সরকার ও বিরোধী দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘাতে বহু মানুষের মৃত্যু ও শত শত মানুষের আহত হওয়ার ঘটনা ক্রমে বাড়ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদী শাসন ও নির্বাচনে কারচুপির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিরোধী দল বিএনপি বলছে, তারা নির্বাচন বর্জন করবে। এ ধরনের বর্জন সংকটকে ঘনীভূত করবে এবং প্রাণঘাতী সংঘাতের পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। এ সমস্যার সমাধানে হলো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন এবং স্থিতিশীল ও দায়িত্ববান সরকার গঠন করা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উগ্রবাদী হয়ে ওঠা, মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি এবং বাংলাদেশের জটিল অর্থনৈতিক গতিপথ সব মিলে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যা যে কোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে।’উল্লেখ্য, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকার যৌথ বাহিনীর নামে আইন–শৃংখলা বাহিনী, দলীয় ক্যাডার এবং বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের নির্মমভাবে ক্রসফায়ারের হত্যা করে এবং বাড়িঘর গুড়িয়ে দেয়। অধিকার এর বার্ষিক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৪ এর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮৯ জন হত্যার শিকার হয় এবং ৯,৪২৬ জন রাজনৈতিক সহিংসতায় আহত , ১৭০ জন বিচার–বহির্ভূত হত্যার শিকার হন। আইন শালিস কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য মতে, ২০১৩ সালে ৮৪৮টি রাজনৈতিক সংঘাতের মাধ্যমে ৫০৭ জন নিহত ও ২২ হাজার ৪০৭ জন আহত হন– যারা অধিকাংশই বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত। এছাড়াও ৫৩ জন গুম বা গুপ্তহত্যা এবং ৭২ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে আমরা কি এ মৃত্যুর মিছিল চলমান থাকবে? এ মৃত্যুপুরী হতে রক্ষার কোন উপায় নেই কি?
‘বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব হলো সকল বিচার–বহির্ভূত হত্যার দ্রুত, স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা’– এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০১৫’র ৮ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে এ দাবি জানায়। নিউইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ৮ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখা, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ইটিভির চেয়ারম্যানকে গ্রেফতারের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। সংস্থাটি বলেছে, বিরোধী দল সমাবেশ করলে নৈরাজ্য ও সহিংসতার সৃষ্টি করবে বলে সরকার যা বলেছে তার স্বপক্ষে কোনো সঠিক তথ্য–প্রমাণ তারা দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সরকারের নির্বিচারে শক্তি প্রয়োগ, বিনা বিচারে গ্রেফতার, সংবাদ মাধ্যমের উপরে বাধা সৃষ্টি, আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে বলে এইচআরডব্লিউ বিবৃতিতে বলা হয়। এছাড়া সরকারকে দমন–পীড়নমূলক কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। এর আগে ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এর বিবৃতিতে জানানো হয়, ‘স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে রক্তাক্ত নির্বাচন ছিল এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে সেসবের যদি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয় তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা খারাপের দিতেই যেতে পারে’। ২০১৪ এর ৮ জানুয়ারি এইচআরডব্লিউ জানায়, ‘সরকারের নির্বিচারে ক্ষমতার অপব্যবহার, গণগ্রেফতার, এবং তথ্য প্রবাহের ওপর বাধা–নিষেধ ইতিমধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। জনগণকে রক্ষায় সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, কিন্তু এটা এমনভাবে করা প্রয়োজন যাতে মানবাধিকার এবং আইনের শাসন লংঘিত না হয়’।
এশিয়া প্যাসেফিক ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট ইনডেক্স ২০১৪ মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পরিমাপেও এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন (স্কোর মাত্র ২৭ দশমিক ৮), ফলে দেশি–বিদেশি বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। ফান্ড ফর পিস প্রণীত ব্যর্থ রাষ্টের সূচক অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৯তম। সর্বোচ্চ ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে অবস্থানরকারী সোমালিয়ার চেয়ে বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও ২০১২ এর তুলনায় তা ০.৩ পয়েন্ট বেড়ে ৯২.৫ এ দাড়িয়েছে। এ অবস্থায় চলমান গুম, হত্যা, দুর্নীতি এবং অর্থনীতির অধোগতি এখন আর অনুমান নয় বাংলাদেশের নিয়তি! এ অবস্থায় প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণই হারছে এবং হারাচ্ছে।।