শাহাদত হোসেন বাচ্চু
বিষ্যুৎবার সকালে ষাট দশকের সবচেয়ে ক্যারিশমেটিক ছাত্রনেতা, উত্তরকালে বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় রাজনীতিক কাজী জাফর আহমেদ (১৯৩৯– ২০১৫) মারা গেলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশে মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরেই গণমানুষের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সবচেয়ে সম্ভামনাময় ছিলেন। স্বাধীনতাত্তোর রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ঘটনার অন্যতম– বিপুল সম্ভাবনায় প্রগতিশীল ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নেতা–কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত ইউনাইটেড পিপলস পার্টির (ইউপিপি) প্রধান রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ধ্বংস করেছিলেন সামরিক সরকারের সাথে আঁতাত এবং রাতারাতি রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হতে গিয়ে। অমাদের দেশের প্রগতিশীল ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনীতির ক্ষেত্রে এর সুদুরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল। পরবর্তীতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল–উপদলে বিভক্ত হতাশ বা ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা (হাতে গোনা দু–একজন বাদে) আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জাতীয় পার্টিতে নিজে কিম্বা দল বিলীন করে ফেলেছেন নানা ধরণের তত্ত্ব হাজির করে।
তুখোড় বক্তা ও সংগঠক কাজী জাফর আহমেদ সত্তর দশকের গোড়ায় আমাদের ছাত্রজীবনে রাজনীতির অন্যতম আইকন ছিলেন, যতদিন না তিনি নষ্ট–ভ্রষ্ট রাজনীতির হাত ধরেছেন অথবা তার গোটা রাজনৈতিক শরীরে পচন ধরেছে। রাজনীতিকে তিনি নষ্ট করেছিলেন, নাকি রাজনীতি তাকে নষ্ট করেছিল, সে প্রশ্নের উর্ধে চলে গেলেন তিনি। তবে পেছনে রেখে গেছেন আড়াই দশকের বর্ণাঢ্য এবং রাজনীতি (১৯৫০–৭৫) আর বাকী চার দশকের (১৯৭৬–২০১৫) বিতর্কিত, গণবিচ্ছিন্ন ও ক্ষমতার রাজনীতির নোংরামী। তাঁর মূল্যায়নের দায় ইতিহাসের কাছে থাকুক, যদিও জাগতিক হিসেবের মধ্যে তিনি নেই, তবুও তাঁর বহুল কথিত উক্তিটি মনে করতে চাই– ‘রাজা যায় রাজা আসে, মন্ত্রী যায় মন্ত্রী আসে, থাকে শুধু ইতিহাসের প্রবাহমান গতিধারা’।
ষাট দশকের গোড়ার দিকে প্রগতিশীল ছাত্রনেতা কাজী জাফর ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এবং বাষট্টির শিক্ষা কমিশন আন্দোলনের অন্যতম নেতা। এসময় তিনি কমিউনিষ্ট পার্টি রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের আদর্শিক বিরোধের আঁচ এসে লাগে উপমহাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টিগুলোতে এবং সোভিয়েত ও চৈনিক ধারায় বিভক্ত হয়ে যায় দলগুলি। কাজী জাফর আহমেদ এ সময় যুক্ত হন চৈনিক ধারার সুখেন্দু দস্তিদার–হক–তোয়াহা নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টির (মার্কসবাদী–লেনিনবাদী) সাথে। এর আগেই ছাত্র সংগঠনে ভাঙ্গন আসে এবং বিভক্ত পূর্ব পাকিস্তার ছাত্র ইউনিয়নের পিকিং ধারার নেতৃত্বে আসেন রাশেদ খান মেনন ও মস্কোপন্থীদের নেতৃত্ব দেন মতিয়া চৌধুরি। এই ভাঙ্গনে কাজী জাফর সমর্থন দিয়েছিলেন মেনন গ্রুপকে।
১৯৬৭–৬৮তে পিকিং ধারার কমিউনিষ্ট পার্টির আরেক দফা ভাঙ্গনে জাফর–মেনন–রনোর নেতৃত্বাধীন উপদলটি কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটি গঠন করে শ্রেনী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার্টি গড়ে তোলার বক্তব্য হাজির করেন। ষাট ও সত্তর দশকে এ দেশের রাজনীতিতে জাফর– মেনন– রণো, তিনটি নাম সমার্থকভাবেই উচ্চারিত হতো। প্রসঙ্গত: স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা কায়েমের লক্ষ্যে তারা সংগঠিত হতে শুরু করেণ। কৃষক অধ্যুষিত এলাকায় তাদের যথেষ্ট রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল। এসময় পার্টির শ্লোগান ছিল ‘কৃষক শ্রমিক অস্ত্র ধর– পূর্ববাংলা স্বাধীন কর’। মাওলানা ভাসানীর সূচিত উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কাজী জাফর। গণঅভ্যুত্থানে সৃষ্ট গণবিস্ফোরনের মধ্যে বিভিন্ন গ্রাম– শহরাঞ্চলে তাঁরা কৃষক– শ্রমিকদের সংগঠিত করে ‘কৃষক–শ্রমিক অঞ্চল’ গঠন অব্যাহত রেখেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে পল্টনের এক ঐতিহাসিক জনসভায় রাজনীতিক কাজী জাফর আহমেদ ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’র রূপরেখা ঘোষণা করেণ। কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি সশস্ত্র জনযুদ্ধের লক্ষ্যে সংগঠিত হতে শুরু করে বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা. নরসিংদি, কুমিল্লাসহ পার্টি প্রভাবিত অঞ্চলগুলিতে।
কাজী জাফর সেই তরুণ বিপ্লবী নেতা যিনি কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির সমন্বয়ক হিসেবে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েমের ঘোষণা দিয়েছিলেন, সাত বছরের হুলিয়া মাথায় নিয়ে ছিলেন পাক সামরিক জান্তার জন্য সবচেয়ে বিপদজনক ও ওয়ান্টেড ব্যক্তিদের অন্যতম একজন হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের যৌথ নেতৃত্বে (জাফর–মেনন–রণো) কম্যুনিষ্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি ঘাঁটি ও মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলেছিল বিভিন্ন অঞ্চলে। ১৯৭২ সালে তরুন বয়সে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ভাসানী) সাধারন সম্পাদক হয়েছিলেন, ১৯৭৪ সালে প্রগতিশীলদের নিয়ে গঠন করেছিলেন ইউপিপি, তার ধারাবাহিকতা নিজেই রক্ষা করেননি। ১৯৭৭ সালে, তার ভাষায় বাকশালের পূনরুত্থান ঠেকাতে সামরিক শাসক জিয়ার ছত্রছায়ায় গঠন করেছিলেন জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট, যোগ দিয়েছিলেন ফ্রন্টের মন্ত্রীসভায়। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ভেঙ্গে দিয়ে একক দলে রূপান্তর করার প্রতিবাদে পদত্যাগও করেছিলেন, কিন্ত তাঁর দল ইউপিপির সভাপতি আবদুল হালিম চৌধুরী ও সহ–সভাপতি কর্নেল (অবঃ) আকবর যোগ দিয়েছিলেন জিয়ার সাথে। ফলে তার কৌশলগত পদত্যাগ রাজনীতিতে তেমন আলোড়ন তুলতে পারেনি, যেমনটি তিনি আশা করেছিলেন।
জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে যোগদান প্রশ্নে ইউপিপিসহ ছাত্র–শমিক–কৃষক সব অঙ্গ সংগঠনে ভাঙ্গন দেখা দেয়। দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রণো, অমল সেনসহ উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ আলাদা দল গঠন করেণ যা পরবর্তীকালে ওয়ার্কার্স পার্টি নামে রাজনীতি করলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অংশীদার হিসেবে দলের অস্তিত্ব বিলোপ আনুষ্ঠানিকতার পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। হায়দার আকবর খান রণো পরে সিপিরিতে যোগ দিয়েছেন। অন্যদিকে, ক্ষমতার পিপাসায় আকন্ঠ নিমজ্জিত, আদর্শিক লড়াই ভুলে কাজী জাফর আরেক সামরিক– স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের মন্ত্রীসভায় যোগ দেন ১৯৮৫ সালে, প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। এসময় তিনি জাতীয় রাজনীতিতে হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বাসঘাতকতার অন্যতম প্রতীক এবং জলাঞ্জলী দিয়েছিলেন রাজনীতির সকল সুবচন। অভিযুক্ত হয়েছিলেন চিনি ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির অর্থ আত্মসাতের দায়ে। নব্বইয়ে এরশাদের পতনের পর তিনি ছিলেন পলাতক। ১৯৯৯ সালে আদালত তাকে ১৫ বছরের কারাদন্ডও দিয়েছিল। পালিয়ে গিয়ে অষ্ট্রেলিয়ায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পাওয়ায় বিপাকে পড়েছিল তখনকার অষ্ট্রেলিয় সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারে অধীনে জাতীয় নির্বাচনে যোগ দেয়ার বিরোধিতা করে ২০১৩ সালে আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে যোগ দিয়েছিলেন এবং ছিলেন আমৃত্যু।
আমরা যারা তাঁর একসময়ের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, তারা তাঁকে কিভাবে মনে করবো? ষাট–সত্তর দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলাদেশের কিংবদন্তীতূল্য রাজনীতিক, শ্রমিক নেতা কাজী জাফর আহমেদকে, না সেই কাজী জাফর আহমেদকে যিনি চরম রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব নিয়ে চলে গেলেন। মিডিয়া তার নিত্যদিনের গতানুগতিকতায় তার মৃত্যুর খবর পরিবেশন করেছে, তাও ষাট দশকে তার ভূমিকার ভুল বয়ানে। তার সবশেষ জোটসঙ্গী খালেদা জিয়া ও বিএনপি শোক জানালেও সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন শোক জানানো হয়নি। সব সমালোচনার ঊর্ধে চলে গেছেন তিনি, তার আত্মা শান্তিতে থাকুক।।